24 Feb 2025, 07:53 pm

গবেষণাগারে তৈরি মাছ-মাংস এখন হোটেলে

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : দেশের কথাই ধরা যাক। গরুর মাংসের দাম কেজিতে ৮০০ টাকা, সস্তা হিসেবে পরিচিত ব্রয়লার মুরগির কেজি ২০০ টাকা এবং দেশি মাছ যেমন পাওয়া দুষ্কর, তেমনি পেলেও সাধারণের সাধ্যের বাইরে। এই সমস্যার সমাধানে বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। মাংস আর মাছ তৈরি হচ্ছে গবেষণাগারে। ইতিমধ্যে সিঙ্গাপুরে বাজারজাত শুরু হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রে গত বছরের শেষ দিকে খাওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, ভবিষ্যতে আমিষ আর প্রোটিনের চাহিদা মেটাবে এই গবেষণাগারের খাবার। আসল গরু, মুরগি বা মাছ না হলেও স্বাদ অবিকল বলেই জানিয়েছেন গবেষকরা। থাকবে সমপরিমাণ ভিটামিন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটু বেশিও পাওয়া যাবে। বর্তমানে বিশ্বে মাংসের চাহিদা ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের। আগামী এক দশকের মধ্যে বিশ্বে মাংসের মোট চাহিদার ১০ ভাগের এক ভাগ জোগান দেওয়া হবে প্রাণিকোষ থেকে তৈরি এ ধরনের মাংসের মাধ্যমে।

অগ্রপথিক কারা :ভেবে দেখুন মুরগির মাংস খাচ্ছেন, কিন্তু কোনো মুরগিকে প্রাণে হত্যা করাই হলো না। মাছ খাচ্ছেন, কিন্তু নদী বা সমুদ্র থেকে কোনো মাছ ধরা হয়নি। বিস্ময়কর মনে হলেও এটাই সত্যি। কখনো বিভিন্ন গাছ থেকে, কখনো মুরগি বা মাছের দেহের কোষ থেকে, কখনো বা থ্রিডি প্রিন্ট করে এই আমিষ খাবারগুলো তৈরি করা হয়। অথচ এর ফলে খাবারের পুষ্টিগত উপাদানে কোনো তারতম্য ঘটে না।

১৯৩১ সালে মিডিয়ায় লেখা এক নিবন্ধে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উড্রো উইলসন গবেষণাগারের মাংস তৈরির ধারণা দিয়েছিলেন। এরপর ১৯৫০ সালে ডাচ গবেষক উইলেন ভ্যান এলেন মূলত গবেষণাগারের মাংসের ধারণাটি জনপ্রিয় করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি জেলে ছিলেন। তিনি জেলে খাবারের সংকটে ভুগছিলেন। তখনই তার মাথায় কৃত্রিম মাংস তৈরির চিন্তা আসে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে কোষ থেকে মাংস তৈরির বিষয়টি আলোচনাও করেন।

তবে কৃত্রিম মাংস দিয়ে প্রথম বার্গার তৈরি হয় ২০১৩ সালে লন্ডনে। শেফ রিচার্ড ম্যাকজিওন এটি তৈরি করেন। দুই বছরের চেষ্টায় ৩ লাখ ২৫ হাজার ডলার খরচ করে বার্গারটি তৈরি করা হয়।

মাংসের ভবিষ্যতটা কেমন :ইসরাইলি সংস্থা ‘রিডিফাইন মিট’ মুরগি, গরু, ভেড়া প্রভৃতির মাংস বানায়। বিভিন্ন ধরনের স্টেকও পাওয়া যায় সেখানে। কিন্তু অবাক করার বিষয় এই যে, এই মাংস থ্রিডি প্রিন্ট করে বানানো। তবে এখানে কালির বদলে ব্যবহার করা হয় গাছ থেকে পাওয়া প্রোটিন জাতীয় উপাদান। এই সংস্থার প্রধান নির্বাহী এশার বেন শিট্রিট জানান, এই মাংস খেয়ে কেউ বুঝতেই পারেন না যে, এগুলো আসল মাংস নয়। এর স্বাদ আসল মাংসের মতোই। এমনকি, পুষ্টিগত উপাদানও একই। বরং এই মাংস কোলেস্টেরলমুক্ত যা স্বাস্থ্যের পক্ষেও উপযোগী।

মুরগির মাংস :কেবল গাছ থেকেই নয়, প্রক্রিয়াকরণ করা হয় মুরগির পালক থেকেও। থাইল্যান্ডের ‘সোরায়ুট মেডিক্যাল ক্লিনিকের এক গবেষক জানিয়েছেন, মুরগির পালকের মধ্যেও প্রোটিন আছে। এই প্রোটিন নিয়ে ল্যাবরেটরিতে প্রক্রিয়াকরণ করে মাংস তৈরি হয়। ইউরোপ জুড়ে ২৩ লাখ টন ওজনের মুরগির পালক বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়। এমনকি পৃথিবীতে মোট যত পরিমাণ পালক বর্জ্য উৎপাদিত হয় তার ৩০ শতাংশ আসে এশিয়া মহাদেশ থেকে। পালক দিয়ে মাংস তৈরির কারণে বিশ্বে বর্জ্য পদার্থের পরিমাণও কমছে। আবার মুরগি ছাড়াই ডিম তৈরি হচ্ছে।

আমেরিকার ‘ইট জাস্ট’ নামের একটি সংস্থা ডিম এবং মাংস জাতীয় খাবার উদ্ভিজ্জ প্রোটিন থেকেই তৈরি করে। এই সংস্থার অ্যাম্বাসাডর কাইমানা চি জানান, ২০২০ সালে সিঙ্গাপুর সরকার তাদের বানানো মাংস পুষ্টিগত দিক দিয়ে যথাযথ। দেশটির ‘১৮৮০’ ই পৃথিবীর প্রথম রেস্তোরাঁ যেখানে কাঁচা মাংস থেকে নয়, বরং গবেষণাগারে বানানো মাংস খাওয়ানো হয়। রেস্তোরাঁর কর্মীরা জানিয়েছেন, এখনো পর্যন্ত রেস্তোরাঁয় খেতে আসা কেউই খাবার নিয়ে অভিযোগ করেননি। এছাড়া আমেরিকাতে বহু জায়গায় উদ্ভিজ্জ প্রোটিন উপাদান থেকে তৈরি ‘চিকেন নাগেটস্’ বিক্রি হয়। এই মাংস গবেষণাগারে মুরগির দেহকোষ প্রক্রিয়াকরণ করে বানানো। ‘রিমিল্ক’ নামে একটি ইসরাইলি সংস্থা গরুর দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদনে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। সেখানে দুধ উৎপাদনে কোনো গরুর প্রয়োজন হয় না। দুধে যে প্রোটিন উপস্থিত থাকে, তা ইস্টের সঙ্গে মিশিয়েই দুধ উৎপাদন করা হয়।

মাছের ভবিষ্যৎ :স্যামন মাছ প্রোটিনের মূল উৎস। এছাড়া বিভিন্ন ভিটামিন পাওয়া যায় এই মাছে। তবে গাছ থেকেই এখন স্যামন মাছ পাওয়া যায়। গাছের প্রোটিন নিয়ে ল্যাবরেটরিতে ‘সেল কালচার’ এর মাধ্যমে স্যামন মাছের ফিলে তৈরি করে ইসরাইলের ‘প্ল্যান্টিশ’ নামক সংস্থা। সিঙ্গাপুরের ‘শিয়ক মিটস্’ নামের সংস্থায় সামুদ্রিক মাছ প্রক্রিয়াকরণ করে বানানো হয়। সংস্থার সঙ্গে জড়িত এক চিকিৎসক জানান- কুচো চিংড়ি, গলদা চিংড়ি, কাঁকড়া প্রভৃতির দেহ থেকে কোষ সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরির মধ্যেই আস্ত চিংড়ি বা কাঁকড়ার উৎপাদন হয়। এছাড়া মৌমাছি ছাড়াই মধু তৈরি করছে ইসরাইলি সংস্থা বি আইও। কোনো বিশেষ ঋতুতে নয়, সারা বছর ধরেই এর উৎপাদন হয়। এই মধু এক বছর বয়সী বা তার কম বয়সী বাচ্চাদেরও খাওয়ানো যায়।

হালাল-হারাম নিয়েই দুশ্চিন্তা :কৃত্রিম মাংস উৎপাদনকারীদের সামনে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, তা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। এ নিয়ে নানা পরিকল্পনা করেছেন তারা। যারা প্রাণী হত্যা পছন্দ করেন না, তাদের জন্য এই মাংস খুবই উপকারী হবে। তারা নির্দ্বিধায় খাবেন। কিন্তু মুসলিম এবং ইহুদিদের মধ্যে প্রাণী জবাই করার কিছু রীতি আছে। এগুলো না মানলে তা খাওয়া হারাম। গবেষকরা সেই প্রশ্ন যাতে না উঠে সেদিকেও লক্ষ্য রাখছেন। কৃত্রিম মাংসের প্রতি মানুষের আগ্রহ নিয়ে জার্নাল অব এনভায়রনমেন্ট সাইকোলজির গবেষণায় দেখা যায়, মাংস খাওয়া মানুষের মধ্যে ৩৫ শতাংশ কৃত্রিম মাংস খেতে রাজি নন। আর নিরামিষভোজীদেরও ৫৫ শতাংশের এর প্রতি আগ্রহ নেই। ধারণা করা হচ্ছে, বেশির ভাগ মুসলিম বিশ্ব খামারের ওপর নির্ভর করছেন মাংসের চাহিদা মেটাতে। তখন আরেকটা যে ঝামেলা হবে তা হলো মুসলিম পৃথিবীতে মাংসের জোগান কমে যাওয়া। নিজেদেরই চাহিদা মেটাতে হবে। তবে এই ব্যবসা কারো কারো জন্য বেশ লাভজনক হতে পারে।

পরিবেশের ক্ষতি কতটুকু? :গবেষণাগারে তৈরি মাংস পরিবেশের ওপর চাপ কমাতে পারে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাব অনুযায়ী, গবাদিপশু লালনপালনে প্রচুর গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হয়। এর পরিমাণ বিশ্বে মোট নির্গত হওয়া গ্রিনহাউজ গ্যাসের ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ। যদিও মাত্র তৈরি এবং বাজারে আসা শুরু হলো, তারপরও বোঝা যাচ্ছে গবেষণাগারে তৈরি মাংস অনেক বেশি সবুজ হওয়ার কথা। তথ্য বলছে, গবেষণাগারে মাংস তৈরিতে খামারব্যবস্থার চেয়ে ৪৫ শতাংশ কম বিদ্যুৎ বা অন্যান্য শক্তি খরচ, ৯৯ শতাংশ কম জমি ব্যবহার এবং ৯৬ শতাংশ কম গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত হয়। আবার প্রাণীহত্যা নিয়ে যে বিতর্ক আছে সেটাও হয়তো বন্ধ হবে। অন্যদিকে গরুর খামারিরা যাতে ক্ষতির মুখে না পড়েন সেজন্য তাদেরও গবেষণার সঙ্গে রাখার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। ইতিমধ্যে নেদারল্যান্ডসের খামারিদের সঙ্গে কিছু প্রতিষ্ঠানের চুক্তি হয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 14022
  • Total Visits: 1640010
  • Total Visitors: 4
  • Total Countries: 1714

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ সোমবার, ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ইং
  • ১২ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (বসন্তকাল)
  • ২৫শে শা'বান, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, সন্ধ্যা ৭:৫৩

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
     12
2425262728  
       
15161718192021
293031    
       
  12345
20212223242526
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018